জাতিসংঘ অনেক আগ থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলার বিকল্প নিয়ে কাজ করছে। ব্যাংককে অবস্থানরত জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার রায়দানকারী একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির সঙ্গেও দীর্ঘ বৈঠক করে গেছেন। সেখানে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে আরও দুই মেয়াদে নির্বাচন করার আইনগত দিকও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। তাই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ফোন হঠাৎ আসেনি। যদিও এবারের জাতিসংঘ দূতিয়ালির ট্রিগার টিপেছেন মনে হচ্ছে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জুন।
২১ আগস্ট হোটেল র্যাডিসনে তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপে বসার আহ্বানের পরদিনই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ফোন পান দুই নেত্রী। একই দিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের’ পূর্বশর্ত হিসেবে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় সরকারের পক্ষে সরাসরি মন্তব্য করেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাইরের যেকোনো সক্রিয়তা পরিস্থিতির নাজুকত্ব নির্দেশ করে, যা প্রকারান্তরে একটি সার্বভৌম দেশ ও তার ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি অমর্যাদাকর।
বিএনপি এখনো একটি খবর গোপন রেখেছে। আমরা জানতে পেরেছি, ২৩ আগস্ট বান কি মুন খালেদা জিয়াকে বিএনপির দুজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে জাতিসংঘে পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। বিএনপি এতে নীতিগত সম্মতিও দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত তারা না বদলালে বিষয়টি বাংলাদেশ রাজনীতি ও কূটনীতিতে একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে সাধারণ বিতর্ক। ধারণা করা হচ্ছে, ১৭ সেপ্টেম্বরের পরপরই বিএনপির দুই জ্যেষ্ঠ নেতা নিউইয়র্কের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করবেন। কিন্তু তার আগেই ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশেরও সংসদ অধিবেশন বসবে। কিন্তু তখন অন্তর্বর্তীকালীন বা নির্দলীয় সরকারের লিখিত রূপরেখা সংসদে থাকবে বলে প্রতীয়মান হয় না। এর অর্থ দাঁড়াবে, সরকারবিরোধী একটা অবস্থান নিয়ে একটি স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা নিউইয়র্কে যাবেন। আর তাঁরা তাঁদেরই অবস্থান দেশের মানুষের কাছে অস্পষ্ট রাখবেন। বিএনপি আপাতত আপসের মনোভাব দেখাচ্ছে। হরতাল দিচ্ছে না। লুপ্ত সংশোধনীর পুনরুজ্জীবন চাইছে না। তাই তাদের উচিত জাতিসংঘে যাওয়ার আগে একটি লিখিত বিল আনা। এটা না আনা হবে আত্মঘাতী।
বিএনপিকে কেবলই নির্বাচন নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুতে জামায়াতের প্রতি মার্কিনদের নমনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির কৌশল নির্ধারণ করা ভুল হবে। হাসিনা-মুন কী কথা হয়েছে, সে বিষয়ে বাসস বলেছে, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে আগামী সংসদ অধিবেশনে যোগদান এবং আসন্ন নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে তাদের প্রস্তাব উত্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিবকে আরও বলেছেন, ‘বিরোধী দলের যেকোনো প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাব, যদি তা জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে দেওয়া হয়।’ সরকারি দলের এই অবস্থানকে সংকট মেটাতে কাজে লাগানোই বিএনপির জন্য সমীচীন হবে, আর তাতে জাতিসংঘের নজরদারিও মিলবে।
২৩ আগস্ট বান কি মুন খালেদা জিয়াকে বলেছেন, তিনি (মহাসচিব) বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা খুব একটা এগোয়নি। এ জন্য তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। তবে এ সময়ে জাতিসংঘে তাদের দুই নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর তথ্যও বিএনপি স্বীকার করতে সতর্ক। ২৮ আগস্ট টেলিফোনে এ বিষয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানতে চাইলে শমসের মবিন চৌধুরী বারবার একই সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন: ‘কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো জাতিসংঘের কাছে কিছুই আশা করিনি।’ তাঁর এ কথায় স্পষ্ট যে, বিএনপির সম্ভাব্য জাতিসংঘ মিশনের স্পর্শকাতরতার বিষয়ে তাঁরা সাবধানি। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত প্রকাশ্য ঘোষণা একটি সুদূরপ্রসারী ভিন্নতর রাজনৈতিক মাত্রা বয়ে আনতে পারে। এটা আপাতদৃষ্টিতে কেবলই সরকারি দলের জন্য বিব্রতকর বিবেচনা করাটাও ভুল হবে। এটি বিরোধী দলের জন্য খুব সুখকর মনে করার কারণ নেই। বরং তারা অপ্রকাশ্যে, যে পথে তারা সরকারি দলের সঙ্গে কিছুটা দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল, তেমন কোনো মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারে যে, জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও তা তারা এড়াতেই উদ্গ্রীব।
বিএনপি আগামী নির্বাচনে, না তার পরের নির্বাচনে সরকারে যাবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তবে বাসসের এই খবর ঠিক হলে বিএনপিকে পাঠ নিতে হবে। বান কি মুন শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।’ এই বিষয়টি অনেক বেশি প্রার্থিত ও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থেও। আর সেখানে পরবর্তী সরকারে বিএনপি—এটা কল্পনা করা হলেও বিএনপি নিজেকে তার আগেকার বাংলা ভাইদের প্রতি নমনীয় থাকার কালিমামুক্ত করতে পারেনি। বরং নতুন করে জামায়াতি-হেফাজতি ফাঁদে পা দিয়ে আরও কালি মাখিয়েছে। রাজশাহীতে বাংলা ভাইকে সংবর্ধনা দেওয়ার ভাবমূর্তির চেয়েও ভয়ানক যুগে ফিরে গেছে বিএনপি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর মার খাওয়া সংখ্যালঘুরা কি বিএনপিকে বন্ধু ভাবতে পারছে? প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ বাতিলের ভুল বিএনপি এখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি। সাম্প্রদায়িক ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিএনপিকে তার সম্পর্ক পুনঃ সংজ্ঞায়িত করতে হবে। গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষকের সভায় খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, তিনি বান কি মুনকে সরকারি দলের পদ্ধতিগত দলীয়করণ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এটা বাংলাদেশের শান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু বিএনপির মৌলবাদীকরণ ও ধর্মান্ধকরণ শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতির জন্যও যে হুমকি, এ সম্পর্কে তিনি বান কি মুনকে কিছুই বলেননি। জাতিসংঘে গেলে বিএনপিকে এটাই বেশি করে বলতে হবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস